বাংলা সন ও পহেলা বৈশাখের সংক্ষিপ্ত আলোচনা
- islamipedia1122
- Apr 15, 2019
- 4 min read
লেখক: Syful Alam

-----------------------------------------------------------------------
বৈশাখ নামকরণ করা হয়েছে বিশাখা থেকে। বিশাখা শব্দের অর্থ জানার জন্য বাংলা অভিধানে খোঁজ করলাম। দেখলাম বিশাখার অর্থ শ্রী রাধার সখীদের অন্যতমা সখী; ঐ নামের নক্ষত্র যা জ্যোতির্বিদ্যায় ২৭ নক্ষত্রের একটা। কেউ কেউ বলেন যে, শ্রী রাধার সখী বিশাখার নামেই বিশাখা নক্ষত্রের নামকরণ করা হয়েছে। যদিও এই দাবির পক্ষে অকাট্য কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাংলা সনের প্রবর্তনের ব্যাপারে দুটো মত পাওয়া যায়। কেউ বলেন গৌড় রাজা শশাঙ্ক তার শাসনামলে ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে বাংল সন অর্থাৎ বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন। তবে এই মতের ব্যাপারে শক্তপোক্ত প্রমাণ দাঁড় করানো বেশ কঠিন। দ্বিতীয় মত হল, সম্রাট আকবর পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে আদিল শাহসুরীর প্রধানমন্ত্রী হেমুকে হারিয়ে দিল্লী উদ্ধারের প্রায় ২৯ বছর পরে অর্থাৎ ১৫৮৪ সালে বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। মাওলানা আবুল ফজল 'আকবরনামা' গ্রন্থে বলেন, "হিজরী বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা কৃষকদের জন্য খুবই সাংঘর্ষিক ছিল। কারণ চন্দ্র ও সৌর বর্ষের মধ্যে ১১ থেকে ১২ দিনের ব্যবধান ছিল, ফলে দেখা যায় ৩০ সৌরবর্ষ ৩১ চন্দ্র বর্ষের সমান ছিল। তখন কৃষকরা সৌরবর্ষ অনুযায়ী ফসল সংগ্রহ করত কিন্তু চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হতো।" সম্রাট আকবর কৃষকদের কথা ভেবে সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করতে চাইলেন। তাই সম্রাট ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ফতুল্লাহ শিরাজীর সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত ফার্সি বর্ষপঞ্জির অনুকরণে ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। শিরাজী এই সৌর বর্ষপঞ্জির নাম দেন ফশলি শান (কৃষিপঞ্জি) । যদিও তা তারিখ-ই-ইলাহী নামেই অধিক পরিচিত।
আকবরের গভর্নর বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খান বছরের প্রথম দিনে পুন্যাহ রীতি অর্থাৎ খাজনা নেওয়ার প্রচলন করেন। আমরা এখন বাংলায় ১২ মাসের নাম গণনা করি। কিন্তু সম্রাট আকবরের সময় তা ফার্সিতে নামকরণ করা হয়েছিল। যথা- ১. ফারওয়াদিন ২. আর্দি ৩. ভিহিসু ৪. খোরদাদ ৫. তির ৬. আমারদাদ ৭. শাহরিয়ার ৮. আবান ৯. আযুর ১০. দাই ১১. বহম ১২. ইসক্নদার মিজ। পরর্বতীতে জ্যোতির্বিদ্যার 'সূর্য্যসিদ্ধান্ত' অনুযায়ী বিভিন্ন নক্ষত্রের নামানুসারে বাংলা সনের নাম পরিবর্তিত হয়। বাংলা মাসের এই নামগুলো হলোঃ- বৈশাখ- বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, জ্যৈষ্ঠ- জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, আষাঢ়- উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষেত্রের নাম অনুসারে, শ্রাবণ- শ্রবণা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, ভাদ্র- উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম অনুসারে, আশ্বিন- আশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে, কার্তিক- কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, অগ্রহায়ণ (মার্গশীর্ষ) মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, পৌষ- পুষ্যা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, মাঘ- মঘা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, ফাগুন- উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে, চৈত্র- চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে। এই ১২ মাসের দিনক্ষণেই ১২টি রাশি গণনা করা হয়। যেমন- বৈশাখে মেষ রাশি, জৈষ্ঠ্যে বৃষ রাশি, আষাঢ়ে মিথুন রাশি, শ্রাবণে কর্কট রাশি, ভাদ্রে সিংহ রাশি, আশ্বিনে কন্যা রাশি, কার্তিকে তুলা রাশি, অগ্রাহণে বৃশ্চিক রাশি, পৌষে ধনু রাশি, মাঘে মকর রাশি, ফাল্গুনে কুম্ভ রাশি এবং চৈত্রে মীন রাশি। মূলত প্রাচীন বাংলা সনের রীতির মূলে ছিল কৃষিকাজ। আর বছরের প্রথমে দিনে খাজনা নেওয়ার প্রচলন করে রাজা ও প্রজার মাঝে হৃদ্যতা বাড়ানোর প্রয়াস ছিল মাত্র। পরবর্তীতে ১৯১৭ সালে প্রথম আধুনিক নববর্ষ পালন করা হয় বলে জানা যায়। যার উদ্দেশ্য ছিল ১ম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশদের জয়ের প্রত্যাশা করা। তখন ব্যাপক জাকজমক করে কীর্তন ও পূজার আয়োজন করা হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে এসে সুফিয়া কামালের ছায়ানট প্রথম রমনার বটমূলে এসে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করা শুরু করে। ১৯৬৬ সালে ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র নের্তৃত্বে বাংলা সন সংশোধিত কমিটি গঠন করা হয়। এখানে প্রথম পাঁচ মাসকে ৩১ দিন, আর বাকি মাসগুলোকে ৩০ দিন বানানো হয়। প্রতি অধিবর্ষে ফাল্গুন মাসে ৩১ দিন ধার্য করা হয়। ১৯৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে এই দিনপঞ্জি গ্রহণ করা হয়। এরপর, জাতীয় দিনপঞ্জির সূচনা ও প্রতি বছর নববর্ষ ১৪ এপ্রিলেই হয়ে থাকে।
ছায়ানট ১৯৬৭ সালে তা ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালন করলেও সাধারণ মানুষের মাঝে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
তবে ১৯৯০ এর দশকে নববর্ষ উদযাপন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। সেই শোভাযাত্রায় পাপেট, বিভিন্ন প্রাণীর মুখোশ ও বাদ্যযন্ত্র দেখানো হয়। তারই আদলে ১৯৮৯ সালে স্বৈরাচার শাসক এরশাদের পতন কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। যা ঢাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। পরবর্তীতে প্রতি বছরই আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে চারুকলা অনুষদ। যাতে থাকে বিশালকায় চারুকর্ম পুতুল, হাতি, কুমীর, লক্ষ্মীপেঁচা, ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোশ এবং সাজসজ্জ্বা, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য। ১৯৯৬ সালে এসে এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপ নেন। বর্তমানে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামেই অধিক পরিচিত।
পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের প্রচলন রয়েছে। লোক গবেষক শামসুজ্জামান খান মনে করেন, "বৈশাখে খরার মাসে যখন কোনো ফসল হতো না তখন কৃষকদের হাতে পয়সাও থাকতো না। সুতরাং তাদের পক্ষে ইলিশ কিনে খাওয়া সম্ভব হতো না। সুতরাং এটা মোটেও সত্যি নয় যে, কৃষকরা নববর্ষ উদযাপনে পান্তা ইলিশ খেয়ে বছর শুরু করতো।" সত্যিটা হল আশির দশকে রমনাকে কেন্দ্র করে নববর্ষে কিছু খাবারের দোকান বসে। যারা ছায়ানটের অনুষ্ঠান দেখতে যেতেন তারা সেখানে খেয়ে নিতেন। এমনই একবার অল্প কয়েকজন মিলে পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা বিক্রি করলেন এবং তা সব বিক্রি হয়ে গেল। কয়েকজন বেকার তরুণ এই কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদেরকে উৎসাহিত করতে এবং ‘নতুন একটা কিছু প্রবর্তন’ করার মানসিকতা নিয়ে একটি গ্রুপ এর প্রচারণা চালাতে লাগলেন। যাদের মধ্যে দুই একজন গণমাধ্যমকর্মীও ছিলেন। বিষয়টা আর কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। মুনাফালোভী গ্রুপ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে বৈশাখের অনেক কিছুই কর্পোরেটদের দখলে চলে যায়।
আমরা বুঝতে পারলাম যে, যে উদ্দেশ্যে বাংলা সনের প্রবর্তন হয়েছে। তা থেকে আমরা অনেক দূরে। আধুনিক নববর্ষ উদযাপন ছিল মূলত বৃটিশ বন্দনা। পরবর্তীতে তা এরশাদ হটানোর কামনায় উদযাপন করা হয়। আর পান্তা-ইলিশের গল্প তো ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্য। যাকে বাংলা সংস্কৃতির নামে চালানো হয়। আমরা বাঙালীরা এতটাই অন্ধ যে, যে যা দেয় আমরা তাই নিজেদের সংস্কৃতি মনে করি। আবার বড় গলায় বলি আমরা বাঙালী!!
Comments